ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক:
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধীরা অনাস্থাভোটের দাবি তুলেছিলেন। একবার তা বাতিল হলেও, সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অনাস্থা ভোটের নিয়তিকে খন্ডাতে পারলেন না ইমরান। শনিবার রাতে পাক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ১৭৪টি ভোট পড়ল পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়কের বিরুদ্ধে। আর এর ফলে নিয়ম মেনেই পতন হল ইমরান সরকারের।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে কোনও প্রধানমন্ত্রীই নিজেদের পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করেননি। কখনও খুন হয়ে, আবার কখনও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় গদি ছাড়তে হয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রীদের। পাক রাজনীতিরধারা বজায় রেখে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না ইমরানও। তবে ইমরানই প্রথম পাক প্রধানমন্ত্রী, যিনি বিরোধীদের ডাকা অনাস্থা ভোটের মুখে পড়ে গদিচ্যুত হলেন।
লিয়াকত আলি খান
স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলি খান। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। কিন্তু ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। মোট চার বছর ৬৩ দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।
খওয়াজা নাজিমুদ্দিন
লিয়াকতের পর পাক মসনদে বসেন খওয়াজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৩ সালের ১৭ অগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল ছিলেন। তাঁর সময়কালে বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লাহৌরে একাধিক হিংসার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে তাঁকে গদি ছাড়ার নির্দেশ দেন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মালিক গোলাম। কিন্তু তিনি এই নির্দেশ না মেনে নিতে চাওয়ায় নিজের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে নাজিমুদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যূত করেন মালিক। নাজিমুদ্দিন মোট এক বছর ১৮২ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।
মুহম্মদ আলি বগরা
এর পর প্রধানমন্ত্রী হন মহম্মদ আলি বগরা। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে মোট দু’বছর ১১৭ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসন করেন। নিয়োগের পরপরই, আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ইসকান্দার মির্জার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বোগরার সমস্যা শুরু হয়। এর পরই বোগরাকে একপ্রকার ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন ইসকান্দার।
চৌধুরি মুহম্মদ আলি
পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরি মহম্মদ আলি। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে মোট এক বছরের কিছু বেশি সময় পাকিস্তানের মসনদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন আলি। দলবিরোধী কাজকর্মের জন্য তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়।
হুসেইন শহিদ সোহরাওয়ার্দি
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন হুসেইন শাহিদ সুরাবর্দি। তিনি ১৯৫৬ থেকে শুরু করে এক বছর ৩৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে গভর্নর জেনারেল ইসকান্দারের চাপের মুখে পড়ে হুসেইন শহিদ সোহরাওয়ার্দিও গদি ছাড়তে বাধ্য হন।
ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার
পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার। মাত্র দু’মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চুন্দিরগার। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলার পর তাঁকেও অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।
ফিরোজ খান নুন
এর পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের দায়িত্ব সামলানোর ভার নেন ফিরোজ খান নুন। তাঁর শাসনকালের সময় ছিল ২৯৫ দিন। খুব কম সময়েয় ফিরোজের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছয়। মনে করা হয়, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দখলের ইচ্ছায় ফিরোজ বাধ সাধতে পারেন, এই ভয়ে তাঁকেও গদিচ্যূত করেন ইসকান্দার।
নুরুল আমিন
অষ্টম পাক প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। তিনিই পাকিস্তানের ইতিহাসে সব থেকে স্বল্পমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী। মাত্র ১৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ছিলেন নুরুল। তবে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি নিজের পদ ছাড়েন। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি পাকিস্তানের শেষ বাঙালি নেতা হিসেবেও পরিচিত।
জুলফিকার আলি ভুট্টো
নুরুলের পর ক্ষমতায় আসেন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে তিনি তিন বছর ৩২৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল মহম্মদ জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যূত করে। তাঁকে এক মাসের জন্য আটকও করা হয়।
মুহম্মদ খান জুনেজো
জুলফিকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় আনা হয় মহম্মদ খান জুনেজোকে। তিনি তিন বছরের কিছু বেশি সময় পাক মসনদে ছিলেন। তবে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য দায়ী করে পদ থেকে সরান রাষ্ট্রপতি পদে বসে থাকা জিয়া।
বেনজির ভুট্টো
পাকিস্তানের একাদশ এবং প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকারের মেয়ে বেনজির ভুট্টো। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দাবি করেন, রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী-সহ রক্ষণশীল এবং ইসলামপন্থী শক্তি তাঁর নতুন চিন্তাভাবনার প্রচেষ্টা রোধ করছে। বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ এনে ১৯৯০ সালে ইসহাক তাঁকে বরখাস্ত করেন।
নওয়াজ শরিফ
১৯৯০ সালে দ্বাদশ পাক প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রপতি ইসহাক পাক সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তিনি গদিচ্যূত হন এবং বিরোধী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
বেনজির এবং নওয়াজ
ত্রয়োদশ এবং চর্তুদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও পাকিস্তান শাসনের ভার পান বেনজির এবং নওয়াজ। ১৯৯৬ সাল থেকে বেনজির ৩ বছর ১৭ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বারেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যার চক্রান্ত-সহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়। রাষ্ট্রপতি ফারুক লেগহারি তাঁর সরকার ভেঙে দেন। নওয়াজের দ্বিতীয় বারের শাসনকাল চলে দু’বছর ২৩৭ দিন। এর পর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ফলে তার শাসনকালের অবসান ঘটে।
মির জাফারুল্লাহ খান জামিলি
বেনজির এবং নওয়াজের পতনের পরে ক্ষমতায় আসেন মির জাফারুল্লাহ খান জামিলি। তবে প্রায় দু’বছরের শাসনকালের পর হঠাৎই নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। ইস্তফা দেওয়ার আগে জামিলি প্রায় ৩ ঘণ্টা তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশারফের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিষয়ে মোশারফের মতের সঙ্গে জামিলির মতের মিল না হওয়ায় তাঁকে পদত্যাগের জন্য বাধ্য করা হয় বলেও সংবাদ মাধ্যমগুলি দাবি করে।
চৌধুরি সুজাত হোসেন
ষষ্ঠদশ পাক প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরি সুজাত হোসেন। তাঁর শাসনের সময়কাল ছিল মাত্র ৫৭ দিন। এর পর তিনি নিজেই শওকত আজিজকে নিজের পদ ছেড়ে দেন।
শওকত আজিজ
এর পর প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন শওকত আজিজ। মোশারফের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন শওকত। তিনি তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর নিজে থেকেই সরে যান। তবে শওকতের আমলে পাক অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয় বলে মনে করা হয়।
ইউসুফ রাজা গিলানি
শওকতের পর পাক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ইউসুফ রাজা গিলানি। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি মোট চার বছর ৮৬ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী পদে গিলানিই সব থেকে বেশি দিন বহাল ছিলেন। তবে একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে পাক সুপ্রিম কোর্ট তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদ খারিজ করে।
রাজা পারভেজ আশরাফ
পাকিস্তানের উনিশতম প্রধানমন্ত্রী হন রাজা পারভেজ আশরাফ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শাসনের সময়কালও এক বছর পার করেননি। আশরফ মোট ২৭৫ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তবে ২০১৩ সালে ২৪ মার্চ তিনি তাঁর পদ ছাড়েন। তাঁকেও একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় পাক সুপ্রিম কোর্ট।
নওয়াজ শরিফ
এর পর ২০১৩ সালে ফের ক্ষমতায় ফেরেন আগে দু’বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা নওয়াজ। তবে তৃতীয় বারে চার বছরের ৫৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। তবে ২০১৭ সালে পানামা পেপার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে ক্ষমতাচ্যূত করে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে তাঁকে ১০ বছরের জন্য কারাবাসে পাঠানোরও নির্দেশ দেয়।
শাহিদ খোকন আব্বাসি
নওয়াজের পর ৩০৩ দিনের জন্য একুশতম পাক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শাহিদ খকন আব্বাসি। তবে ২০১৮ সালে নির্বাচনের মুখে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়।
ইমরান
২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ইমরান। পাকিস্তানের ধারা বজায় রেখে ইমরানও মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না।
সূত্র: আনন্দ বাজার অনলাইন