শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি:
বগুড়ার শেরপুরে মিল-চাতাল ব্যবসায়ীর গুদাম থেকে জব্দ করা ৪৫টাকা কেজির চাল ২০টাকা কেজি দরে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্দেশে বিগত দুইদিন ধরে স্থানীয় এলাকাবাসীর মাঝে কমদামে এই চালগুলো বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে পানির দরে চাল বিক্রির খবরে উপজেলাজুড়ে তোলপাড় চলছে। সেইসঙ্গে কমদামে চাল পাওয়ার আশায় অসংখ্য নারী-পুরুষ ভিড় করছেন। এমনকি বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টি উপেক্ষা করেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করছেন তারা।
মঙ্গলবার (০৭জুন) বেলা বারোটার দিকে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক সংলগ্ন উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের গাড়ীদহ দশমাইল এলাকায় অবস্থিত শুভ ও এসএন সেমি অটোরাইস মিল প্রাঙণে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়।
এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিচালিত অভিযানে উদ্ধার হওয়া চাল বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে কমদামে বিক্রি করায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভুক্তভোগীসহ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পেশায় জড়িতদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে চালের বাজার। ফলে বাজার আরও অস্থিতিশীল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চালের বাজারে অস্থিরতা থামাতে অবৈধ মজুদদার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চলছে অভিযান। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরাঞ্চলের অন্যতম চালের মোকাম শেরপুর উপজেলাতেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিগত ০৫জুন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার গাড়ীদহ দশমাইল এলাকায় অবস্থিত শুভ ও এসএন সেমি অটোরাইস মিল নামের ওই প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালান ভ্রাম্যমাণ আদালত। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) সাবরিনা শারমিনের নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
অভিযানকালে ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গুদামে অবৈধভাবে ধান-চাল মজুদ করে রাখায় এক লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেইসঙ্গে ২৪৭ মেট্রিকটন চাল ও ৭৫ মেট্রিকটন ধান জব্দ করেন। এসব ধান-চাল আগামি তিনদিনের মধ্যে বিক্রির নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই বিপুল পরিমাণ ধান-চাল বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। তাই ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। তবে এই চাল বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরকেই দেওয়া হচ্ছে জানা গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থেকেই জব্দকৃত চালগুলো বিক্রি করছেন। চাল কিনতে ভিড় করছেন অসংখ্য নারী-পুরুষ ক্রেতারা। তাই তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে টোকেন দিচ্ছেন তিনি। এরপরও ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা।
এসময় কথা হয় অভিযুক্ত ব্যবসায়ী আব্দুর রহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, তিনিসহ আরও চারজন মিলে যৌথভাবে এই মিল-চাতাল ভাড়া নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। এটির মূল মালিক নারায়ণ দত্ত। তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে খাদ্য গুদামের লাইসেন্স রয়েছে। তাই সরকারি খাদ্যগুমামে চাল সরবরাহের জন্য চালগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছিল।
এছাড়া বাজারে বিক্রির জন্যও মিলের গুদামে রকমারি চাল রয়েছে। পাশাপাশি বড় চাতাল নিয়মিত চালানোর জন্য ধানের প্রয়োজন। তাই কিছু ধান কিনেছেন বলে জানান। কিন্তু এরইমধ্যে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে জরিমানার পাশাপাশি সেসব জব্দ করে বিক্রির নির্দেশ দিয়েছেন। তাই বিক্রি করা হচ্ছে। এই ব্যক্তিসহ উপস্থিত একাধিক ব্যবসায়ীর দাবি, বিশ টাকা কেজি দরে যে চাল বিক্রি করা হচ্ছে, তার বর্তমান বাজারমূল্য ৪৫টাকা। আর যে চাল চল্লিশ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে তার মূল্য প্রতি কেজি ৫৮-৬০টাকা। আমরা জানি, জব্দকৃত সরকারি কোনো মাল বিক্রির ক্ষেত্রে দরপত্র আহবান করে সর্বোচ্চ বাজারদর অনুযায়ী বিক্রি করে রাজস্ব বাড়ানো হয়ে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো ঘটনা। কোনো প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই পানির দরে বিক্রি করা হচ্ছে চাল। ব্যবসায়ীও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারও রাজস্ব পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তারা।
চাল কিনতে আসা সোলায়মান আলী নামের এক ক্রেতা বলেন, চাল বিক্রির খবর পেয়ে সকালে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর দুই হাজার টাকায় এক বস্তা (১০০কেজি) চাল পেয়েছেন। এত কমদামে চাল পাবেন তা ভাবতেই পারছেন না বলে দাবি করেন। সুফিয়া বেওয়া নামের আরেক নারী বলেন, বৃষ্টির মধ্যে প্রায় চার ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও চাল পাননি। বড় সাহেবরা আসেননি তাই চাল দেওয়া বন্ধ। স্যারেরা এলে চাল বিক্রি করা হবে। কিন্তু আজকে আর আসবে না। তাই খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছি।
বিষয়টি সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চাইলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) সাবরিনা শারমিন এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, গুদামে অবৈধভাবে ধান-চাল মজুদ করে রাখায় জরিমানা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বিগত বছরের চাল মজুদ পাওয়ায় সেসব জব্দ করে তিনদিনের মধ্যে বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা সেটি করেননি। এছাড়া চাল বিক্রির মূল্য আমরা নির্ধারণ করিনি। মজুদদার ওই ব্যবসায়ী বিশ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করছেন। ভালো মানের চালগুলো চল্লিশ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। সেইসঙ্গে এসব চাল বিক্রির টাকা তারাই নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেবল সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে এবং জনস্বার্থে ভ্রাম্যমাণ আদালত, জনপ্রতিনিধি ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত রয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।