মাস্টার নজরুল ইসলাম:
১৪৯৮ সালে পুর্তগীজ নাবিক ভাস্কোডা-গামা ভারতে প্রথম আসেন। ১৫০২ সালে তিনি দ্বিতীয়বার আসেন। ১৫০৫ সালে ফ্রান্সিসকো দ্য আলমেডিয়া আসেন। ১৫০৯ সালে আসেন ফানসো দ্য আল বুকার্ক । ইংরেজরা প্রথম আসে ১৬০০ সালে। সকল ইউরোপী নাবিক এখানে এসে ব্যবসা করলেও ইংরেজ বণিকরা শুরু করে শয়তানি। তাদের শয়তানিতে রুষ্ট হয়ে নবাব শায়েস্তা খান বাংলায় ইংরেজদের সকল প্রকার বানিজ্য বন্ধ করে দেন। ১৬৬৮সালে শায়েস্তা খানের স্থলে ইবরাহীম খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। ইংরেজরা অতীত অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে বানিজ্য সুবিধা ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করে এবং বানিজ্য সুবিধা আবার ফিরে পায়। তারা বানিজ্য সুবিধা ফিরে পেয়ে বর্ণ হিন্দুদের সাথে মৈত্রির সম্পর্ক তৈরি করে। নবাব আলীবর্দীখান ১৭৪০ সালে ক্ষমতা লাভ করেন। ক্ষমতায় বসে তিনি ইংরেজ, বর্ণহিন্দু, মারাঠা বর্গী, রোহিলাদের সাথে নানাবিধ সমস্যার মোকাবিলা করেন। এই সুযোগে ইংরেজরা ১৭৫৪ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ নির্মান করে। ১৭৫৬ সালে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর মৃত্যুর পর ইংরেজ ও বর্ণ হিন্দুরা ষড়যন্ত্রের চুরান্ত পর্যায়ে এসে প্রথমে ইয়ার লতিফকে, পরে বিশেষ বিবেচনায় মীর জাফরকে বেছে নেয় ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য।
১৭৫৭ সালের ১ লা মে তারা মীর জাফরের সাথে এগার দফা গোপন চুক্তি করে। সেই চুক্তির বলে তারা ২৩ শে জুন পলাশির আম বাগানের যুদ্ধ নামক নাটকের মধ্য দিয়ে নবাব সিরাজ কে পরাজিত করে এবং পরে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়া হয়। ১৭৫৭ সালের ২৯ শে জুন পরাধীন দেশের পুতুল নবাবরূপে মসনদে বসেন মীর জাফর। ৩জুলাই রাজকীয় শান শওকতের সাথে দুইশত নৌকা বোঝাই সোনা চাঁদি মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় পাঠানো হয় ইংরেজদের যুদ্ধের ক্ষতিপুরণ হিসেবে ।
১৭৬৫ সালে তারা দিল্লীর স¤্রাট বাহাদুর শাহের নিকট থেকে বাংলার রাজস্ব আদায়ের অনুমতি পত্র লাভ করে। যুদ্ধ জয়ের বখশিস হিসেবে ক্লাইভ মীর জাফরের নিকট থেকে ২,৩৪,০০০ পাউন্ড নেয়। মীর জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছয়জন কর্মচারীকে ১,৫০,০০০ পাউন্ড দেয় উৎকোচ হিসেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কলকাতা কাউন্সিলের প্রত্যেক সদস্যকে ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ হাজার পাউন্ড দিতে হয়েছে। (ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহীম: বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস)।
কোম্পানীর ও কলকাতার অধিবাসীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এবং সৈন্য ও নৌবহরের ব্যায় বাবদ কোম্পানী আদায় করে ২৫,৩১,০০০পাউন্ড। মীর জাফর ইংরেজ কর্মকর্তাদের খুশি করতে,৬,৬০,৩৭৫ পাউন্ড উপঢৌকন দেন। ইংরেজ কর্মচারীরা মীর জাফরের নিকট থেকে চব্বিশপরগণা জেলার জমি এবং ৩০,০০,০০০ পাউন্ড ঘুষ গ্রহন করে। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভকে ৩৪,৫৬৭ পাউন্ড বার্ষিক আয়ের দক্ষিন কোলতার জায়গীর দিতে হয়।(ব্রিজেন কে গুপ্ত: সিরাজদ্দৌলা এন্ড দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী)। ইংরেজদের টাকার দাবি মেটাতে মীর জাফর রাজকোষ শুন্য করে ফেলেছিল। মীর কাশিম এই ঋণ পরিশোধ করে মসনদের বিনিময়ে কোম্পানীর কর্মচারীদেরকে ২,০০,০০০ পাউন্ড দিয়েছিলেন।( ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহীম: বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস)। মীর জাফরের পুত্র নাজমুদ্দৌলা ১৭৬৫ সালে পিতার মৃত্যুর পর মসনদ লাভের জন্য কোম্পানীকে ঘুষ দেয় ৮,৭৫,০০০ পাউন্ড। রেজা খান ২,৭৫,০০০ পাউন্ড ঘুষের বিনিময়ে এই অপ্রাপ্ত নবাবের নাযিম নিযুক্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশ বছরে ইংরেজরা এদেশ থেকে ৬০,০০,০০০ পাউন্ড ঘুষের নামে আত্মসাৎ করেছিল।
কোম্পানীর কর্মচারীরা প্রথম সুযোগেই এই অর্থ ইংল্যান্ডে নিয়ে যায়। ক্লাইভের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলে তিনি নিজের আচরণের সমর্থনে বলেন “ পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর আমার যে অবস্থা হয়েছিল, তা আপনার ভেবে দেখুন। একজন বড় রাজার ভাগ্য আমার ইচ্ছার উপর নির্ভ করছে। একটি সমৃদ্ধ নগর আমার দয়ার প্রতীক্ষায় আছে। আমার মুখের সমান্য হাসিতে কৃতার্থ হওয়ার জন্য ধনী মহাজনেরা একে অন্যের সাথে প্রতিযোগীতা করছে। আমার দুই পাশে সোনা, মুণি-মুক্তায় পূর্ণ সিন্দুকের সারি এবং এবং এগুলি কেবল আমারই জন্য খোলা হয়েছে। এ মুহুর্তে আমি নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যাই যে তখন আমি কিভাবে নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিলাম।”(সুপ্রকাশ রায়: ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম)। বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন ইংরেজরা একা করেনি। তাদের সহযাত্রী ছিল এদেশীয় বর্ণ হিন্দু দালাল সহচর গোমস্তা বেনিয়াগোষ্ঠী। ইংরেজদের বর্ণনা মতে“ কোম্পানীর কর্মচারীরা তাদের প্রভু ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জন্য নয়, নিজেদের জন্য প্রায় সমগ্র অভ্যন্তরীন বানিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।……… ব্রিটিশ কোম্পানীর প্রতিটি কর্মচারী ছিল তাদের উচ্চ পদস্থ মনিবের শক্তিতে বলিয়ান। আর এই মনিবদের প্রত্যেকের শক্তির উৎস ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। তাদের ব্যাপক লুণ্ঠন ও শোষনের ফলে শিঘ্রই কোলকাতা বিপুল ধন সম্পদে ¯ু‘পিকৃত হলো। সেই সাথে তিন কোটি মানুষ দুর্দশার শেষ ধাপে এসে দাঁড়ালো। বাংলার মানুষ শোষণ ও উৎপীরন সহ্য করতে অভ্যস্থ একথা ঠিক কিন্তু এ ধরনের ভয়ঙ্কর শোষণ ও উৎপীরন তারাও কোনদিন দেখেনি।” সুপ্রকাশ রায় ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম)। ইংরেজরা ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রথমে তারা গ্রাম-সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে দেয়। এই কাজটি করে তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে। কেননা গ্রাম-সমাজ কাঠামোর ফলে এখানে ইংরেজদের কোনো পণ্য বাজার পাচ্ছিল না। গ্রাম-সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে তারা ভুমি রাজস্বের নতুন ব্যবস্থা চালু করে এবং ভুমি রাজস্ব হিসেবে ফসল বা উৎপন্ন দ্রব্য আদায়ের প্রচলিত পদ্ধতি বদলে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। “এই দুই অস্ত্রের প্রচন্ড ধ্বংসকারি আঘাতে অল্পকালের মধ্যেই বাংলা ও বিহারের প্রাচীন গ্রাম-সমাজের ভিত্তি ধুলিসাৎ হইল। বিহার ও বাংলা শ্মশান হইয়া গেল।” (সুপ্রকাশ রায়:ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম)। আগে এখানে গ্রাম-সমাজের নিকট থেকে রাজস্ব নেয়া হতো, কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে নয়। ইংরেজরা এই সুপ্রাচীন ব্যসস্থা ধ্বংস করে ব্যক্তির নিকট থেকে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যে নিষ্ঠুরতম ব্যক্তিদেরকে ‘নাযিম’ নিয়োগ করে। “নাযিমরা জমিদার ও কৃষকদের কাছ থেকে যত বেশি পারে কর আদায় করে নিচ্ছে। জমিদাররাও নাযিমের কাছ থেকে চাষীদের লুণ্ঠন করার অবাধ অধিকার লাভ করেছে। ‘নাযিমরা’ আবার তাদের সকলের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার রাজকীয় বিশেষ অধিকারের বলে দেশের ধন সম্পদ লুট করে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছে।” এই নিষ্ঠুরতার কারনে ১৭৬৫-১৭৬৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহনের পর সে বছরই তারা প্রায় দ্বিগুন অর্থাৎ দুইকোটি কুড়িলাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে। ইংরেজদের রাজস্বনীতি ও ভুমিব্যবস্থা সম্পর্কে সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, “ এই সকল ব্যবস্থা ফলে চাষীদের পিঠের উপর বিভিন্ন প্রকারের পরগাছা শোষকদের একটা বিরাট পিরমিড চাপিয়ে বসে। এই পিরামিডের শীর্ষ দেশে ইংরেজ বণিক আর নিচে রহিল বিভিন্ন প্রকারের উপস্বত্বভোগীর দলসহ জমিদার গোষ্ঠী। এই বিরাট পিরামিডের চাপে বাংলা বিহারের অসহায় কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে অনিবার্য ধ্বংকের মুখে এসে দাঁড়াল।” ইংরেজরা দস্যুতা করে কৃষকের নিকট থেকে কেড়ে নেয় জমি, ব্যবসায়ীর নিকট থেকে কেড়ে নেয় ব্যবসা এবং চাপিয়ে দেয় তাদের রাজস্বনীতি। ফলে দশ বছরের মধ্যে বাংলা বিহার ও ওড়িষ্যায় নেমে এল এক নিষ্ঠুর নিদারুণ দুঃখ কষ্ট। ইংরেজদের নয়া রাজস্বনীতির কারনে কৃষকরা খাজনার টাকা রোজাগাড় করার তাকিদে বছরের খাদ্য ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ইংরেজরা মুনাফা শিকারের সেরা সুযোগরূপে বেছে নেয় চালের মজুতদারীকে। তারা চালের এক চেটিয়া ব্যবসা কুক্ষিগত করার জন্য বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ব্যবসা কেন্দ্র খুলে ফসল ওঠার সাথে সাথে চাউল মজুদ করে রাখত। পরে সুযোগ বুঝে চাষীদের নিকট তাদেরই রক্ত পানি করা শ্রমের ফসল কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করত। তাদের এই একটি ব্যবস্থাই ভারতের শস্যভান্ডার নামে খ্যাত মোঘল সম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ প্রদেশ যেখানে মুসলিম শাসনের দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশ বছর মানুষ কখনো দুর্ভিক্ষের সাথে পরিচিত ছিল না সেই বাংলা ও বিহারে স্থায়ী দুর্ভিক্ষের কেন্দ্রে পরিণত হলো।
ঘটনাটি এরকম হৃদয় বিদারক ‘ ১৭৬৯সালে ফসল ওঠার সাথে সাথে ইংরেজরা বাংলা ও বিহারের সকল ফসল কিনে ফেলে। সারা বছর মজুদ করে রেখে ১৭৭০ সালে (বাংলার ১১৭৬ সালে) সে খাদ্য শস্য কয়েকগুণ বেশি দামে বেচতে শুরু করে। কয়েক বছরের নিষ্ঠুর শোষণে সর্বস্বান্ত কপর্দকশূন্য কৃষক ও কারিগরদের পক্ষে এত চড়া দামে সে চাল কিনা সম্ভব ছিল না। ফলে বাংলা ও বিহারে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষে কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুর শিকার হয়। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল এক কোটি পঞ্চাশ লাখ। ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত এই মহা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ লেখক ইয়ং হ্যাসবেন্ড লিখেছেন “ তাদের অর্থাৎ ইংরেজ বণিকদের মুনাফা শিকারের পরবর্তী উপায় হলো চাল কিনে গুদামজাত করে রাখা। তারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য এই পণ্যের জন্য তারা যে দাম চাইবে, তাই তারা পাবে। দেশে যা কিছু খাদ্য ছিল তা ইংরেজ বণিকদের এক চেটিয়া দখলে চলে গেল। কৃষকের ঘরের খাদ্যের পরিমাণ যত কমতে লাগল ততই দাম বাড়তে লাগল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির-দুঃখময় জীবনের উপর পতিত হলো এই পুঞ্জিভুত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু এটি এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের শুরু মাত্র। দেশীয় জনশত্রুদের(বর্ণহিন্দু দালাল বেনিয়া গোষ্ঠি) সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তি অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ যে অর্ভতপূর্ব বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা দিল, তা এমনকি ভারতবাসীরাও আর কখনো দেখেনি বা শুনেনি।” “চরম খাদ্যাভাবের এক বিভীষিকাময় ইঙ্গিত নিয়ে দেখা দিল ১৭৬৯ সাল। সাথে সাথে বাংলা ও বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক, তাদের সকল আমলা-গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিল, সেখানেই দিন রাত পরিশ্রমে ধান চাল কিনতে লাগল। এই জঘন্যতম ব্যবসায় মুনাফা হলো এত শীঘ্র ও এতই বিপুল পরিমান যে, মুর্শিদাবাদের নবাবদরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূন্য ইংরেজ ভদ্রলোক এই ব্যবসা করে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রায় ষাট হাজার পাউন্ড ইউরোপে পাঠিয়েছিলেন।” “ বাংলার সমগ্র ইতিহাসে এই দুর্ভিক্ষ এরূপ একটি নতুন অধ্যায়ের যোজনা করেছে,যা মানব সমাজের সমস্ত অস্তিত্বকালব্যাপী ব্যবসানীতির এই ক্রুর উদ্ভাবন শক্তি কথা স্মরণ করিয়ে দেবে; অলঙ্ঘনীয় মানবাধিকার সমুহের ওপর কত ব্যাপক,গভীর ও কত নিষ্ঠুর ভাবে অর্থ লালসার উৎকট অনাচার চলতে পারে, এই অধ্যায়টি তারও কাল জীয় নির্দশন হয়ে থাকবে।”( ইয়ং হ্যাসবেন্ড)। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার বিবরণ দিয়ে এল এস এস ও মলী লিষেছেন,“ চাষীরা ক্ষুধার জ¦ালায় তাদের সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হলো। কিন্তু কে তাদের কিনবে? কে তাদের খাওয়াবে? বহু এলাকায় জীবিত লোকেরা মরা মানুষের গোশত খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছে। নদী-তীর লাশ আর মুমূর্ষূদের দেহে ছেয়ে গিয়েছিল। মরার আগেই মুমূর্ষ লোকদের দেহের গোশত শিয়াল কুকুরে খেয়ে ফেলতো।” ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, “১৭৬৯ সনের শীতকালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যার জের দুই পুরুষ ধরে চলে। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয় ইতিহাস ছিল চমকপ্রদ সামরিক সাফল্যে প্রাণবন্ত কোম্পনির প্রশংসাপত্রসহ ধারাবাহিক সংগ্রামগুলোর সমাহার সুতরাং যুদ্ধ বা সংসদীয় বিতর্কের সাথে সংযোগহীন এই ঘটনা(দুর্ভিক্ষ) সম্পর্কে তাদের বক্তব্যের বিশেষ সম্পর্ক নেই বললেই চলে।……. ১৭৭০ সনের সারা গ্রীষ্মকাল জুড়ে গণমড়ক অব্যাহত থাকে। কৃষকেরা গবাদিপশু বিক্রি করে দেয়। বিক্রি করে কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি; তারা বীজধান খেয়ে ফেলে; নিজেদের ছেলেমেয়েদের তারা বিক্রি করতে থাকে এবং তারপর তারও কোনো ক্রেতা পাওয়া যায় না। তারা গাছের পাতা, ক্ষেতের ঘাস খেতে থাকে এবং ১৭৭০ সনের জুন মাসে দরবারের আবাসিক প্রতিনিদি শব ভক্ষণের সত্যতা সমর্থন করেন। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত রোগগ্রস্ত হতভাগ্যের দল দিবা-রাত্রি বড় বড় নগরগুলো পূর্ণ করতে থাকল। বছরের প্রথমে মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। …. অর্ধমৃতদের সাথে শবদেহের অবিন্যস্ত স্তুুপে পথ অবরুদ্ধ, নির্বিচারে কবর দিয়েও সমস্যার আশু সুরাহা হলো না। এমন কি প্রাচ্যের ঝাড়–দার হিসেবে খ্যাত শিয়াল কুকুরের দলও সাফাইয়ের বিতষ্ণাকর কাজে ব্যর্থ হলো এবং অবশেষে পচাগলা শবদেহগুলো নাগরিকের অস্থিত্ব বিপন্ন করে তুলল।….সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ১৭৭০ সনের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বিনষ্ট হয়। জুন মাসে মৃত্যু সংখ্যা হিসেবে বল হয় ‘সমগ্র জনসংখ্যার প্রতি ষোল জনে ছয় জন মৃত; এবং হিসেব করে দেখা যায় যে কৃষকসহ খাজনা প্রদানকারী জনসাধারণের অধিকাংশ ক্ষুধার জ¦ালায় ধ্বংস হবে। বর্ষাকালে জনশুন্যতা এত প্রকট হয়ে উঠে যে আতংকগ্রস্ত সরকার পরিচালক সভার কাছে দুর্ভিক্ষ দ্বারা বিনষ্ট কৃষক ও ক্ষুদে উৎপাদকদের সংখ্যা সন্বন্ধে উদ্বেগ প্রকার করে।”(ডবলিও ডবলিউ হান্টার; গ্রাম বাংলার ইতিকথা। অসীম চট্টপাধ্যায় কৃত তরজমা) উইলিয়াম হান্টার আরও লিখেছেন, “১৭৭২সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ জনসাধারণ বাংলাকে একটা বিশাল গুদামখানা হিসেবে দেখত, যেখানে বেশ কিছু দুঃসাহসী ইংরেজ মোটা লাভে এক বিশাল ব্যবসা চালাচ্ছে। বিপুল দেশীয় জনসংখ্যা সম্বন্ধে তারা সচেতন ছিল ঠিকই, এটা যেন তারা একটা আকস্মিক পরিস্থিতি বলে বিবেচনা করত। ” হান্টার সাহেব আরো লিখেছেন,“ বিশ হাজার লোক যে জেলায় প্রতিমাসে মারা যাচ্ছে, সে জেলার ত্রাণ কার্যের জন্য কোম্পানি সরকার একশত পঞ্চাশ টাকা বরাদ্দ করে। চার লাখ উপবাসী মানুষের প্রতিদিনের সাহায্যের জন্য এক প্রাদেশিক পরিষদ গভীর বিবেচনার পর মহানুভবতার সাথে দশ শিলিং মূল্যের চাল অনুমোদন করেন। অর্ধেক কৃষক ও প্রজা উপবাসে মারা যাবে’ এই সতর্কবাণী সত্ত্বেও কোম্পানি কাউন্সিল তিন কোটি মানুষের জন্য ছয় মাসের নির্বাহের জন্য অনুদান ধার্য করেন চার হাজার পাউন্ড।”( গ্রাম বাংলার ইতিকথা)। দুর্ভিক্ষের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,“ যে দেশের জনসাধারণ সম্পূর্ণ কৃষিজীবী সেখানে গণমৃত্যুর ফলে আনুপাতিক হারে জমি অনাবাদি থাকে। বাংলাদেশের জনসাধারণের এক তৃতীয়াংশ মারা যায় এবং এক তৃতীয়াংশ আবাদি জমি দ্রুত পতিত জমিতে পরিণত হয় দুর্ভিক্ষের তিন বছর পর এত বেশি জমি অকর্ষিত থাকে যে দেশীয় রাজন্যবর্গের দল প্রজাদেরকে বাস্তু ত্যাগ করে পরিষদ শাসিত এলাকায় আনার জন্য পরিষদ ব্যবস্থা গ্রহন শুরু করে। দুর্ভিক্ষ পরবর্তী প্রথম পনের বছরে জনশূন্যতা অবিচলিতভাবে বাড়তে থাকে। ঘাটতির সময়ে সবচে বড় বিপর্যয়ের শিকার হয় শিশুরা এবং ১৭৮৫ সন পর্যন্ত বৃদ্ধরা মারা যায়। কিন্তুু তাদের শূন্যস্থান পূরণের জন্য নতুন কোন প্রজন্ম ছিল না। জমি পতিত পড়েই রইল এবং তিন বৎসরের সতর্ক তদন্তের পর ১৭৮৯ সনে লর্ড কর্ণওয়ালিশ বাংলার কোম্পানির এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে বন্যজন্তু-আকীর্ণ জঙ্গল বলে ঘোষনা করেন।” এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে ১৭৭২ সালে বাংলা ও বিহারের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস লিখেন,“ প্রদেশের সমগ্র লোকসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের মৃত্যু এবং তার ফলে চাষের চরম অবনতি স্বত্তে¦ও ১৭৭১ সালের নীট রাজস্ব আদায় এমনকি ১৭৬৮ সালের রাজস্বের চেয়ে বেশি হয়েছে। যে কোন লোকের পক্ষে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে এরূপ একটা ভয়ংকর বিপর্যয়ের মধ্যে রাজস্ব তুলনামূলকভাবে কম আদায় হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা না হওয়ার কারণ এই যে, সকল শক্তি দিয়ে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার লিখেছেন,“ ১৭৭২ সালে পুরোনো চাষীরা মরীয়া হয়ে তাদের কাজ ছেড়ে দিলে তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং বকেয়া খাজনার দায়ে কলকাতার ঋণগ্রস্তদের কারাগারে তাদেরকে কয়েদ করা হয়। রাজস্ব নির্ধারণের প্রতিটি পর্যায়ে একই ঘটনা ঘটে। দুর্ভিক্ষের প্রায় ২০বছর পর ব্রিটিশরা জেলের দায়িত্ব গ্রহণকালে জেল গুলো বকেয়া খাজনা জনিত বন্দীতে পূর্ণ ছিল এবং কোনো বন্দীরই পুনঃমুক্তির কোনো আশা ছিল না। দেশ যখন প্রতিটি বছরের সাথে আরো অধঃপতিত হচ্ছে তখন ইংরেজ সরকার ক্রমাগত বর্ধিত খাজনা দাবি করতে থাকে। ১৭৭১ সলে অবাদি জমির এক তৃতীয়াংশেরও বেশি জমি সরকারি হিসেবে পরিত্যক্ত দেখানো হয়। ১৭৭৬ সনে এই হিসেবে সমগ্র আবাদি জমির অর্ধাংশেরও বেশি দাঁড়ায়, প্রতি সাত একর আবাদি জমির সাথে চার একর পতিত থাকে। অন্যদিকে কোম্পানির দাবি ১৭৭২ সালে ১০,০০,০০০ পাউন্ডের কম হতে বেড়ে ১৭৭৬সনে প্রায় ১১,২০,০০০ পাউন্ডে দাঁড়ায়। বাংলায় ইংরেজ বণিক শ্রেণী ও তাদের সহচর আলম চাঁদ, জগতশেঠ, নব্য বিত্তাশালি, বেনিয়া, নিলামে জমিদারি ক্রয়কারি বর্ণহিন্দু, শহুরে জমিদার শ্রেণি, দালাল নায়েব গোমস্তা গোষ্ঠী সারা বাংলার খাদ্য শস্য মজুত করে রেখে যে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল ইতিহাসে তার তুলনা চলে না। স্বল্পকালের লুণ্ঠনের ফলে কোম্পানীর কর্মচারিরা সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। ইংরেজ বণিকদের এই লুণ্ঠন শোষনকে তারাই ‘মৃত্যুর শাসন’ ‘নেকড়ের শাসন’ নামে অভিহিত করেছেন। সিয়ারুল মুতাখখেরিন গ্রন্থের লেখক গোলাম হুসাইন তাবাতাই কাতর কণ্ঠে বলেছেন,“ ইয়া আল্লাহ তোমার দুঃখ দুর্দশাক্লিষ্ট বান্দাহদের সাহায্যের জন্য একবার তুমি আসমান হতে জমিনে নেমে আস। এই অসহনীয় উৎপীড়ন থেকে তুমি তাদের উদ্ধার কর”। নবাবী আমলের গ্রাম-সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য ইংরেজরা ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। ‘চিরস্তায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যাস্ত আইনের দ্বারা মুসলমানদের হাত থেকে সমস্থ ইজারা,জমিদারি, একে একে খসিয়ে ফেলে নতুন হিন্দু জামিদার ও তালুকদার শ্রেণীর আমদানি করা হয়। যে সব হিন্দু কর আদায়কারী ঐ সময় পর্যন্ত নি¤œ পদে চাকরিতে নিযুক্ত ছিল, নয়া ব্যবস্থা বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণিতে উন্নিত হয়( ইন্ডিয়ান মুসলমান; উইলিয়াম হান্টার)। শহীদ তিতুমীর গ্রন্থের প্রণেতা আব্দুল গফুর সিদ্দিকী লিখেছেন,“ হেস্টিংস এর চুক্তি(১৭৭২-১৭৯৩)ও লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্তায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩) ফলে এদেশের বুনিয়াদি ও পুরনো জামিদারদের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি। নিলামের ডাকে যারা প্রচুর অর্থ দিতে পারতো তাদেরকেই জমিদারী দেওয়া হতো। পুরনো জমিদারদের পক্ষে ইংরেজদের চাহিদা মাফিক অর্থ দেওয়া সম্ভব ছিল না। এতদিনের মজুতদারি লাভের প্রচুর জমানো টাকা নিয়ে এগিয়ে এল বেনিয়ান, গোমস্তা, মহাজন আর ব্যাংকের মালিকরা। লুণ্ঠন শোষণের মাধ্যমে অর্জিত নগদ টাকার জোরে রাতারাতি তারা জমিদার হয়ে বসল। তাদের সকলেরই ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু। তাদের গোত্রীয় পরিচয় দেব, মিত্র, বসাক, সিংহ, শেঠ, মলিক, শীল,তিলি, সাহা। তাদের অনেকেরই পূর্ব পরিচয় তারা পুরাতন জমিদাদের নায়েব কিংবা গোমস্তা। আর তাদের অভিন্ন পরিচয় তারা বাংলা নব্য প্রভু শাসকদের দালালরূপী লুটেরা শোসক।
মুসলমান জমিদারদের জমিদারী দখল এবং মুসলমানদের লাখেরাজ সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ব্রাহ্মণ কায়স্থ ও বৈদ্যরা খ্রিষ্টান পাদ্রিদের সাথে ষড়যন্ত্রে মিলিত হয়। পাদ্রিদের পরামর্শে কোম্পানীর সরকার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আয়মা লাখেরাজ ও তৌজি লাখেরাজের দলিল দস্তাবেজ ও সনদ পাঞ্জা কোম্পানি সরকারে দাখিল করার জন্য এক আকস্মিক নির্দেশ জারি করে। মুসলমানদের অনেকেই এসব দলিল পত্র মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দাখিল করতে পারল না। তাদের সমুদয় লাখেরাজ সম্পত্তি দখল করা হয়। এছাড়া মুসলমানদের অধিকাংশ জমিদারী পাদ্রিদের সুপারিশে কোম্পানীর সরকার খাস করে নেয় এবং পরে তা ব্রাহ্মন কায়স্ত ও বৈদ্যদের বন্দোবস্ত দেয়।” মুসলিম শাসন আমলে জমিদারদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হতো। তারা ছিলেন বিভিন্ন ভাবে জমির অধিকারী এবং রায়তদের কাছ থেকে খাজনা আদায় কারী সরকারী কর্মচারী মাত্র। নিজ নিজ এলাকায় সাধারণ ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তি করা এবং শাসন বিভাগের আংশিক দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত ছিল। জমিদাররা রায়তদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে পারতেন না। কিংবা কোনরূপ অত্যাচার করতে পারতেন না। রায়ত ও জমিদারদের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে ফৌজদারগণ দায়িত্ব পালন করতেন। কোন কারনে জমিদাররা সরকারের অবাধ্য হলে বা জনসাধারণের প্রতি অত্যাচারী হলে তাদের জমিদারী ছিনিয়ে নেওয়া হতো।”(পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ)। ইংরেজ শাসকরা মুসলিম শাসনের এই পদ্ধতির খোল নলচে পাল্টে দেয়। তাদের ও তাদের সমর্থক জমিদারদের খাজনার দাবি মিটাতে কৃষকেরা তাদের জমি বাড়ি ঘর বন্ধক রেখে ঋণ গ্রহনের জন্য মহাজনদের শরণাপন্ন হয়। সুদে আসলে সে ঋণ পরিশোধ করতে কৃষকরা ব্যর্থ হয় আর মহাজনেরা তাদের ঘরবাড়ি জমি-জিরাত কেড়ে নেয়। এভাবে মহাজনরা কালক্রমে জমিদার হয়ে ওঠে এবং ইংরেজদের শোষণের যোগ্য অংশীদারে পরিণত হয়। বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের ব্যবসায় মহাজন মাত্রই হিন্দু। এবং এসব হিন্দুরা ইংরেজদের নিকটতম বন্ধু ও সহযোগী ছিলেন। কৃষকরা তাদের ফসল বিক্রি করতে মহাজনদের নিকট যেত। মহাজনেরা ফসলকে কম দামে ক্রয় করে নিত। এছাড়া কৃষকের আর কোনো উপায় ছিলনা। অল্পদামে ফসল বিক্রি করে তারা ইংরেজদের খাজনার টাকা জোগার করতে পারতোনা। তখন মহাজনের নিকট আবার ঋণ নিত। একসময় কৃষকরা তাদের জমি এবং ফসল দুটাই মহাজনের নিকট দিতে বাধ্য হত। এ প্রসঙ্গে আর পি দত্ত লিখেছেন,“ বৃটিশ ভারতে একজন কৃষকের বার্ষিক গড়পরতা আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। ট্যাক্স ও খাজনা এবং মহাজনের ঋণ বা ঋণের সুদ পরিশোধ করার পর কৃষকের হাতে অবশিষ্ট থাকত মাত্র ১৩ থেকে ১৭ টাকা। অর্থাৎ আয়ের এক তৃতীয়াংশ হাতে নিয়ে কৃষকের সারা বছর কিভাবে চলবে সেই সমস্যার কথা ভাবতে হতো।(ইন্ডিয়া টু ডে)। ইংরেজ ও হিন্দু বেনিয়াগোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে গ্রাম- সমাজ, কৃষি, শিল্প ধ্বংস করে যদি তারা মুসলিম আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখত তাহলেও দুইশত বছর পরে মুসলিমরা আবার দাঁড়াতে পারতো। সাড়ে পাঁচশত বছরের মুসলিম শাসনে এদেশে শিক্ষার একটা সুমহান ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। ফলে স্বাক্ষরতার হার ছিল প্রায় শতভাগ। ইংরেজরা ক্ষমতা গ্রহনের পর সেই ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে যায়, তাই মুসলিমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণগুলি হলো ১.ইংরেজ ও হিন্দু সহচরদের শোষণ ও লুণ্ঠনের ফলে মুসলমানদের সামনে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা নেমে আসে। ২.ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াফত করার ফলে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়।৩. নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজরা বেতন প্রথার সৃষ্টি করে। ৪. মুসলিম শিক্ষার্থীর জন্য ধর্মীয় শিক্ষার সংকোচন করা হয়। ৫. খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মের দর্শনের ব্যাপক প্রভাব প্রবর্তন করা হয় ফলে মুসলিম ছেলেমেয়েদের খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ৬.মুসলিম শিক্ষার্থীকে বিধর্মীদের শিক্ষা গ্রহনে বাধ্য করা হয়। ৭.মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি সাহায্য বন্ধ করা হয়। ৮. মুসলমানরা আত্মমর্যাদা বোধের কারনে প্রতারক শত্রুদের শিক্ষা গ্রহনে অনিহা প্রকাশ করতো। মুসলিম শাসনামলে এদেশে আশি হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশ বিদেশর যুবকরা এসে শিক্ষা নিত। শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ন অবৈতনিক। শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতো রাষ্ট্র। এজন্য নবাবী আমলে লক্ষ লক্ষ বিঘা জমি ছিল লাখেরাজ বা ওয়াকফ। আর বাংলার প্রচুর পরিমান জমি ছিল নিষ্কর। এসব জমি দিয়ে শিক্ষার যাবতীয় ব্যয় রাষ্ট্র বহন করতো। ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে এসব ভুমি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে, ফলে মুসলিম আমলের শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। লর্ড টমাস ব্যারিংটন মেকলের পরামর্শে ১৮৩৫ সালে শিক্ষা সংক্রান্ত আইন প্রনয়ন করে। এই আইনে ইংরেজী স্কুল ছাড়া আর সব প্রতিষ্ঠানকে সরকারি সাহায্যের অনুপোযুক্ত ঘোষনা করা হয়। মেকল বলেন,“ বর্তমানে আমাদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে, সমাজে যারা শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। তারা রক্তে মাংসের গড়নে ও দেহের রঙে ভারতীয় হবে বটে; কিন্তুু রুচি,মতামত ও বুদ্ধির দিক দিয়ে হবে খাঁটি ইংরেজ।” তারা ১৮৩৭ সালে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজীকে সরকারি ভাষা ঘোষনা করে। ফলে মুসলমানদের যাবতীয় ক্রিয়াকান্ড অচল হয়ে পড়ে। ১৮৪৪ সালে তারা ঘোষনা করে যে একমাত্র ইংরেজী শিক্ষিতরাই সরকারি চাকুরির উপযুক্ত। এর ফলে শিক্ষিত মুসলমানরা বেকার হয়ে যায়। হাজি মুহাম্মদ মুহসিন ফান্ডের লাখ লাখ টাকা ইংরেজরা তসরুপ করে এবং হিন্দুদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করে এবং মুসলিমদের কে বঞ্চিত করে। মুহসিন ফান্ডের টাকা ইংরেজরা এদেশে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করে এবং এসব প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রদের ভর্তি নিষিদ্ধ ছিল। নতুন গজিয়ে ওঠা হিন্দু জমিদারদের জমিদারি ছিল পূর্ব বাংলায় আর জমিদারির আয় ব্যয় করতো হিন্দু এলাকায়। তারা পূর্ব বাংলার জমিদারির টাকায় কোলকাতার হিন্দুদের জন্য স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে আর শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখেছিল পূর্ব বাংলার মুসলিমদেরকে। ইংরেজ শাসনামলে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশে কোনো কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেনি। ১৮৪৬ সালে ঢাকার স্কুল কলেজে ২৬৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মুসলমান ছিল মাত্র ১৮ জন।
১৮৫৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মাত্র চার দশকের মধ্যে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৫গুন। এই ছাত্রদের প্রায় সবাই বর্ণহিন্দু। ১৮৮১ সালে ১৭১২ জন গ্রাজুয়েটের মধ্যে ১৪৮০ জনই ছিল বাঙ্গালী বর্ণ হিন্দু। বাঁকিরা উড়িয়া অসমীয়া বা বিহারি। একই বছর সমগ্র উপমহাদেশে ৪২৩ জন এম এ ডিগ্রী লাভ করে। তার মধ্যে ৩৪০জন ছিল বাঙ্গালী বর্ণহিন্দু। ভারতের অন্য সকল স্থানের ছাত্রদের সম্মিলিত সংখ্যা মাত্র ৮৩ জন। মুসলমানদের জন্য সর্বনাশকৃত এই শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন,“ আমাদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা হিন্দুদেরকে শতাব্দীর নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে তাদের নিষ্ক্রিয় জনসাধারণকে মহৎ জাতিগত প্রেরণায় উজ্জিবিত করে তুলতে পারলেও তা মুসলমানদের ঐতিহ্যের পরিপন্থি, তাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং তাদের ধর্মের কাছে ঘৃণার্হ। আমাদের প্রবর্তিত জনশিক্ষা ব্যবস্থা যেমন তাদের নিকট গ্রহনযোগ্য হয়নি, তেমনি তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যে আর্থিক সাহায্য এতকাল তারা পেয়ে এসেছিল, তাও আমরা বিনষ্ট করেছি।”( ইন্ডিয়ান মুসলমান) । হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজ প্রভুদের পদলেহন করে প্রচুর টাকা আয় করতে পারতো এবং সে টাকায় তারা সন্তানদের ইংরেজী স্কুলে পড়িয়ে সরকারী চাকুরি বাগিয়ে নিত। মুসলমানদের আর্থিক দৈন্যতার কারনে এবং রাষ্ট্রের অসহযোগীতার কারনে সন্তানদের ইংরেজী স্কুলে পাঠাতে পারতো না। এর ফলে মাত্র একশত বছরের মধ্যে প্রায় শতকরা শতভাগ মুসলমান নিরক্ষর জাতিতে পরিণত হয়।