সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪ ১:৫৪ অপরাহ্ণ
সর্বশেষ সংবাদঃ

১৯৯১ সালে কুয়েতি তেলক্ষেত্রে লাগানো আগুন যেভাবে নেভানো হয়েছিল

অনলাইন ডেস্ক:

উনিশশ’ একানব্বই সালের ইরাক যুদ্ধের পর কুয়েত থেকে পশ্চাদপসরণরত ইরাকি বাহিনী কুয়েতের তেলক্ষেত্রগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল – যা জ্বলেছিল মাসের পর মাস।

একে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়। সেই আগুন নেভাতে আনা হয়েছিল বিশেষজ্ঞ অগ্নিনির্বাপকদের।

কিভাবে তারা সেই আগুন নিভিয়েছিলেন – জানতে বিবিসির সাইমন ওয়াটস কথা বলেছেন সেই অগ্নিনির্বাপকদের একজন রিচার্ড হ্যাটিবার্গের সাথে।

প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে ১৯৯১ সালে ইরাকি বাহিনী পরাজিত হবার পর স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন তার সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কুয়েতের তেলকূপগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিতে।

কুয়েতের তেলক্ষেত্রগুলোর ২৫ শতাংশই তখন কালো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে। সেখানকার বিভিন্ন অবকাঠামো পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করা হয়। ইরাকি বাহিনী সেখানে পোড়ামাটি নীতির বাস্তবায়ন শুরু করে।

ইরাকি বাহিনী সর্বমোট ৭০০ তেলকূপে অন্তর্ঘাত চালিয়েছিল। এতে শত শত কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছিল।

জ্বলন্ত তেলকূপগুলোর ধোঁয়া এক সময় কুয়েত সিটিতে এসে পৌঁছায়। এতে আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়, তার পর শুরু হয় বৃষ্টি। কুয়েতের উত্তরদিকে এ কারণে ১০ গজের বেশি দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।

তেলকূপের আগুন নেভাতে পৃথিবীর সেরা অগ্নিনির্বাপকদের কুয়েতে আনা হয়েছিল

তেলকূপগুলো থেকে মরুভূমির আকাশে বৃষ্টির মধ্যেও আগুনের বিশাল শিখা ওপর দিকে উঠছিল। বৃষ্টির পানিতে কুয়েত সিটির রাস্তাগুলোয় বন্যা দেখা দিয়েছিল। সেখানকার আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটতে থাকে।

এই দুর্যোগ সামাল দেবার জন্য কুয়েতের আমির পৃথিবীর সেরা অগ্নিনির্বাপকদের নিয়োগ করলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন টেক্সাসের পল রেড এডেয়ার।

তিনি বলেন, “এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। বিরূপ প্রকৃতি, প্রচণ্ড গরম, পেতে রাখা বোমা, ল্যান্ডমাইন, পানির অভাব, এবং এত বেশিসংখ্যক জ্বলন্ত তেলকূপ – সব মিলিয়ে এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ। “

রিচার্ড হ্যাটিবার্গ ছিলেন রেড এডেয়ারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাথীদের একজন। তিনি বলেন, “আমাকে বলা হলো, কাল সকালেই আমাদের রওনা দিতে হবে। আমি বললাম , সে কি? কি বলছো? পল বললো, তুমি কুয়েত যাচ্ছো।”

কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তিনি কুয়েতের মাটিতে পা রাখলেন। তখন কুযেতের যে চেহারা – তাকে রিচার্ডের মনে হলো সাক্ষাৎ নরক।

তেলক্ষেত্রগুলোতে আগুন জ্বলেছিল মাসের পর মাস

“ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে আমাদের বিমান নামলো। তারপর আমরা গাড়িতে তেলক্ষেত্রের দিকে গেলাম। দেখলাম আমার চোখের সামনেই শ’দুয়েক কূপে আগুন জ্বলছে। আক্ষরিক অর্থেই আমার চোখে জল এসে গেল। আমি ভাবতেই পারছিলাম না কেউ এমন একটা কাজ করতে পারে। “

“আমরা যা করছিলাম তা শুধু কুয়েত নয় সারা পৃথিবীর জন্য। অনেক সময় আমরা দিনের আলো দেখতে পেতাম না। যেখানে ওই সময় ১৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাথা থাকার কথা – কিন্তু ধোঁয়ায় সূর্য ঢাকা পড়ার কারণে তাপমাত্রা ছিল ৮০-র কোঠায়। কোন রোদ ছিল না। এ দৃশ্য না দেখলে আপনি বিশ্বাস করবেন না।”

এই রকম পরিবেশেই এক অত্যন্ত কঠিন কাজ শুরু করলেন তারা।

“তেলকূপগুলোতে আগুন নেভানোর আসল কাজটা আমরা শুধু দিনের বেলা করতে পারতাম। কারণ ওগুলোর কাছে প্রচণ্ড শব্দের জন্য কারো কথা শোনা যায় না। ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলকে হয়। সে কারণে আমরা আমাদের নিজস্ব লোকদের নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই দলে প্রায় ১২০ জন লোক ছিল। “

জ্বলন্ত তেলকূপের দিকে এগুচ্ছেন রেড এডেয়ারের অগ্নিনির্বাপকরা

উত্তর আমেরিকার অগ্নিনির্বাপক দলের এই কর্মীরা এ কাজটা করতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন কারণ তাদের ভালো বেতন দেবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, এবং তাদের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতার মানসিকতা – বলছিলেন রিচার্ড হ্যাটিবার্গ।

“আমরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতাম কোন গ্রুপ কতগুলো আগুন নেভাতে পারে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা যখন আমাদের অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত মিটিংগুলো করতাম – তখন আমাদের মধ্যে এসব কথা হতো। কোন গ্রুপ হয়তো বড়াই করে বলতো – আমরা আজকে পাঁচটি কুপের আগুন নিভিয়েছি।”

“আমার গ্রুপ কিন্তু সবচেয়ে বেশি কূপের আগুন নেভায়নি। এমন হতো যে আমরা কোন একটা বড় আগুন নেভাতে চাইলাম, তখন অন্য একটা গ্রুপ গিয়ে ৩৫-৪০ মিনিটেই সেটা নিভিয়ে ফেলতো। “

“যে কূপগুলোর আগুন নেভানো সবচেয়ে কঠিন ছিল – সেগুলো ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রথম বিপদ ছিল যুদ্ধের সময় ফেলে যাওয়া অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ ও গ্রেনেডগুলো অপসারণ করা। এর পর আসল কাজ – জ্বলন্ত তেলকূপটির আগুন নেভানো। শুরু হতো।”

ইরাকিরা তেলকূপগুলোর ভেতরে বিস্ফোরক পেতে রেখে এই কাজটা যতটা কঠিন করা সম্ভব করে গিয়েছিল।

সবচেয়ে মারাত্মক আগুনটা নেভাতে রিচার্ড হ্যাটিবার্গ ও তার দলের সময় লেগেছিল ১৩ দিন।

জ্বলন্ত তেলকূপের পাশে অগ্নিনির্বাপক দল

“আগুনটা জ্বলছিল প্রায় ১০০ একর জায়গা জুড়ে। আগুনের শিখা ছিল তিনশ ফুট উঁচু। এটা ছিল একটা বড় আকারে তেলকূপ যাতে তেল ও গ্যাস দুটোই ছিল। আমাদের একেকবারে খানিকটা করে আগুন নেভাতে হচ্ছিল। কিন্তু এত বড় জায়গা নিযে আগুনটা জ্বলছিল যে – আসল তেলকূপটা যে ঠিক কোথায় – তা আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না। এক সময় আমরা একটা জায়গায় পৌঁছালাম – যেখান থেকে তেলকূপটা ১০০ ফুট দূরে। “

“আমার নিজেদেরকেই দু-চারটা গালি দিলাম। আমাদের একদিন দেরি হয়ে গেল।”

“আমরা নতুন আরেকটা পরিকল্পনা করলাম। একটা ঘোরানো রাস্তা তৈরি করে কূপটার কাছে পৌঁছলাম। এই কূপটার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছিল। আমাদের কূপটার সাথে সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছিল।”

“হ্যালিবার্টন আমাদের জন্য একটা বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেছিল। আগুন নেভাতে আমরা ব্যবহার করেছিলাম পানি, বালু এবং এক ধরনের জেল-এর সংমিশ্রণ । এটাকে বলতে পারেন জেট কাটার। আমরা জিনিসটাকে অতি উচ্চ চাপে পাম্প করে তেলকূপটার ভেতরে ভরে এর মুখ বন্ধ করে দিতাম। কাজটা করতে ৪৫ মিনিট লাগতো। এর পর কূপটার মুখে একটা ব্লো-আপ প্রতিরোধী যন্ত্র বসিয়ে দিতাম। এ কাজ শেষ হলে আমরা পরবর্তী কূপ নেভাতে যেতাম। “

একটি তেলকূপের আগুন নেভানোর পর অগ্নিনির্বাপকরা

“একটা তেলকূপের আগুন নেভানোর পর কি অনুভূতি হতো বলা কঠিন তবে সবচেয়ে বড়টা নিয়ন্ত্রণে আনার পর সেই রাতে আমরা অনেক আনন্দ উদযাপন করেছিলাম। “

কুয়েতের মানুষও এই কঠিন কাজের জন্য এই অগ্নিনির্বাপক দলকে স্বাগত জানিয়েছিল।

“বাস ভরে কুয়েতি মহিলারা এসেছিলেন। তারা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তাদের সাথে কিছু শিশুও ছিল।তারা কূপগুলো দেখতে চাইছিলেন। তাদেরকে আমরা জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখালাম, তাদের বুঝিয়ে বললাম – কিভাবে আমরা আগুন নেভাচ্ছি। প্রায় চার ঘন্টা তারা আমাদের সাথে ছিলেন। তারা আমাদের ধন্যবাদ দিলেন, আর পরের দিন আমাদের সাথে দুপুরের খাওয়াদাওয়া করলেন। “

“স্থানীয়দের সাথে আমাদের কোন সমস্যাই হয় নি। তারা যতভাবে সম্ভব আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। “

সবগুলো তেলকূপের আগুন নেভানো সম্ভব হয় ১৯৯১ সালের শেষ নাগাদ । কুয়েতিরা এ জন্য একশ কোটি ডলারেরও বেশি খরচ করেছিল – যন্ত্রপাতি কেনা ও হাজার হাজার অগ্নিনির্বাপক নিয়োগ দেবার জন্য।

“আমরা যখন দেশে ফিরে যাবার জন্য কেএলএমের বিমানে উঠলাম – তখন আমাদের শ্যাম্পেন দেয়া হয়েছিল। খুশির কথা যে এই কাজ করতে গিয়ে আমাদের গ্রুপে কারো প্রাণহানি বা কোন ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। আমরা যত দ্রুত সম্ভব এ কাজটা করতে পেরেছি।”

“এটা এমন একটা ঘটনা ছিল যা আগে কখনো ঘটেনি। ভবিষ্যতেও আবার ঘটবে বলেও মনে হয়না। কাজটা করে আমি আনন্দ পেয়েছি।”

সূত্র- বিবিসি

Check Also

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা!

অনলাইন ডেস্ক: নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন জেসিন্ডা আরডার্ন। ঘোষণাটি নিয়ে যে বিস্তর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *