সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪ ১২:৩৩ অপরাহ্ণ
সর্বশেষ সংবাদঃ

শ্রমিকের পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলাম


-এ্যাডঃ আব্দুর রহিম মিঠন

———————-
ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। এক সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সুমহান সমাজ গঠনে প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট পারিশ্রমিক লাভ করে। মানুষ পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করবে এটাই মহান মাবুদের চিরন্তন বিধান। ইসলাম কারো অধিকার নষ্ট করাকে অমার্জনীয় অপরাধ বলে ঘোষনা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসের সকল মতবাদ ও মতাদর্শ শ্রমিকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ এমনকি অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালাচ্ছে। অথচ শ্রমিকদের ঘাম ঝড়ানো রক্তের উপর দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য্য ও আবিস্কার এবং ঐসব ক্ষমতা ও অর্থশালীরা শ্রমিকের কষ্টের উপরই দাড়িয়ে আছে। এমতাবস্থায় ইসলামই শুধুমাত্র শুধুমাত্র সর্বজনিন ঘোষনা দিয়ে শ্রমজীবি মেহনতী মানুষের প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা নয় বরং এ অধিকার খর্ব করাকে যুলুম ও শোষন বলে আখ্যায়িত করেছে।

নবী-রাসূলগনের নিকট শ্রমিকরে মর্যাদাঃ-
# আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সাঃ) বলেছেন- আল্লাহ এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি ছাগল চড়াননি। – বুখারী
# মালিক হযরত শোয়াইব (আঃ) তার মেয়ের বিবাহ দিয়ে নবী হযরত মূসা (আঃ) জামায় বানিয়েছেন (মেশ/ছাগল চড়ানোর বিনিময়ে)। (সুরা কাসাস:২৭-২৮)
# হযরত দাউদ (আঃ) ছিলেন কর্মকার। তিনি রাষ্ট্র হতে ভাতা গ্রহন না করে নিজ হাতে তৈরীকৃত যন্ত্রাদি বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
# প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ) ছিলেন কৃষক। জান্নাতে গমনকারী কৃষকদের তিনি হবেন সর্দার ।
# হযরত ইদ্রীস (আঃ) ছিলেন দর্জি।
# হযরত নূহ (আঃ) ছিলেন সুতার।
# হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মুতার যুদ্ধে শ্রমিক যায়েদকে করেন প্রধান সেনাপতি।
# হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) শ্রমিক বেলালকে করেন ইসলামের প্রথম মোয়াজ্জিন।
# হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নিজ খাদেম আনাস (রাঃ) বলেন- ১০ বছরে তিনি আমাকে একটি বারের জন্যও ধমক দেননি, এমনকি কোন কাজ না করার জন্য তিনি বলেননি যে, কেন কাজটি করনি?
# হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এক সাহাবীর হাতে পাথুরে জমিতে কোদাল চালানোর কারনে কাল দাগ পড়ায় সে হাতে চুম্বন খান।
# হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কাবাচত্বরে শ্রমিকের অধিকার ঘোষনা করে দীর্ঘ ভাষনে ইসলামই কেবল শোষিত, বঞ্চিত, অধিকার হারা মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষমতা প্রমানিত হয়েছে।

ইসলাম পূর্ব শ্রমিকের অধিকার:
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আগমনের পূর্ব যে সভ্যতাকে নিয়ে আজও ইউরোপিয়ানরা ও বস্তাপচা মতবাদের ধজাধারীরা সে সময় শ্রমিকদের নূণ্যতম অধিকারতো দূরের কথা বরং হাটে বাজারে পশুর ন্যয় বিক্রয় হত শ্রমিকরা, সামান্য ভুলে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করা, দিনশেষে ১০-১৫ জনের দলকে লোহার শিকল লাগিয়ে হাতে পায়ে বেড়ী পড়িয়ে এক অন্ধকার কুঠরীতে আবদ্ধ করা এমনকি সে অন্ধকার কুঠরিতেই প্রশ্রাব পায়খানা করতে হতো। কখোনো দাসদের লড়াই লাগাইয়ে একজনকে দিয়ে আরেকজনকে হত্যা করে তারা হাততালি দিত। সারাদিন পশুর মত খাটিয়ে দিনশেষে সমান্য খাবার এমনকি কখোনো পানি পর্যন্ত পেতনা শ্রমিকের ঘরে জন্ম নেওয়াটাই যেন অপরাধ। ঐসব নির্যাতনের কালোথাবায় আজকের সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীরা আজ নিত্য নতুন আধুনিক পন্থায় শ্রমিকদের নির্যাতনের ব্যবস্থা করছে। যার জন্য প্রতিনিয়তই ঘটছে শ্রমিক নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা। এমতাবস্থায় ইসলাম সর্বজনিনতা ঘোষনা করে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।

শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম:
# শ্রমে উৎসাহ প্রদান:
# মহান আল্লাহ বলেন- “অতপর নামাজ শেষ হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং সন্ধান কর আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক)”। -সুরা জুমুয়াহ ১০
# হযরত মিকদাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেন- নিজ হাতে কামায় করা খাবারের চেয়ে প্রিয় ও উত্তম খাবার কেউ খায়নি। (বুখারী-২০৭১)।
# সুবিধা বঞ্চিতদের অধিকার: আল্লাহ বলেন- “আর তাদের মহান আল্লাহর ঐ মাল হতে দও, যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন।” –(সুরা আন নুর ৩৩)
সম্পদে অধিকার ঘোষনা করে তিনি আরও বলেন- “ আর তাদের সম্পদে সাহায্য প্রার্থী ও সুবিধা বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে”। – (সুরা যারিয়াত ১৯)
# মালিকের সাথে শ্রমিকের সম্পর্কে অধিকার:
১. আল্লাহ বলেন- “মুমিনগন পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা ভাইয়ের সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা কর”। (সুরা হুজরাত ১০)
# আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন- কোন ব্যক্তি ততক্ষন পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষন না, অন্যের জন্য তাই পছন্দ করবে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। (বুখারী ও মুসলিম)
# রাসূল (সাঃ) আরও বলেন- মুসলমান পরস্পর ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না, অসহায়ভাবে ছেড়ে দেবেনা, মিথ্য বলবে না, অপমান করবে না। (বুখারী ও মুসলিম)। এছাড়াও রাসূল (সাঃ) চাকর/ শ্রমিকদের একই দস্তরখানে/ টেবিলে খেতে বসার তাগিদ করেছেন। যাতে শ্রমিক ও মালিকের মাঝে কোন পার্থক্য না থাকে।
# শ্রমিকের কাজের সময় ও ধরনে অধিকার: আন্তর্জাতিক শ্রমনীতির আলোকে কাজের সময় নির্ধারন করা হয়েছে আটঘন্টা। অথচ সহজ-হালকা-ভারী কাজের পার্থক্য শীত-গ্রীস্ম একজন রোদে পুরে অপরজন এসি রুমে কাজ করে এটা কখোনো ইনসাফ হতে পারে না। এজন্য মহান আল্লাহ বলেন- “কারো উপর সামর্থ্যের অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবেনা”। (সুরা বাকারা ২৩৩)।
রাসুল (সাঃ) বলেন- শক্তি সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকের উপর চাপাবে না। (বুখারী ও মুসলিম)। আরও বলেন- কর্মচারী ও শ্রমিকের কাজ যতটা হালকা করবে তোমদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও পূণ্য লেখা হবে। (তারগীব ও তারহীব)।
# শিশু শ্রমিকের অধিকার: রাসূল (সাঃ) বলেন- যারা ছোটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন ও বড়দের সম্মান করেনা তারা আমার দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ)।
# পারিশ্রমিক প্রাপ্তিতে শ্রমিকের অধিকার: আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্নিত, রাসূল (সাঃ) কোন শ্রমিককে প্রারিশ্রমিক/মুজুরী নির্ধারন না করে নিযুক্ত করতে নিষেধ করেছেন। (বায়হাকী ২১৫৯)। এছাড়াও রাসূল (সাঃ) বলেন- “শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই মুজুরী পরিশোধ কর”। (বায়হাকী ১১৬৫৪)
# ন্যয় বিচার প্রাপ্তিতে অধিকার: বর্তমানে বিত্তশালী ও ক্ষমতাশালীদের বিচার হয় একভাবে আবার দরিদ্রদের অপরাধ না করেও মিথ্য মোকদ্দমায় দোষ চাপিয়ে সাজা ভোগ করতে হয় ঐসব ক্ষমতাশালীদের দাপটে। এমতাবস্থায় মহান আল্লাহ ন্যয় বিচারের ঘোষনা দিয়ে বলেন- “বিশেষ শ্রেণীর প্রতি বিদ্বেশ যেন অবিচার করতে উদ্বুদ্ধ না করে”। (মায়েদা-৮)।
আল্লাহ আরও হুশিয়ারী দিয়ে বলেন- “হে ঈমানদারগন ন্যয়নীতি নিয়ে শক্তভাবে দাঁড়াও। আল্লাহর জন্য সাক্ষী হও। তোমাদের সুবিচার যদি পিতা-মাতা ও নিকটাত্বীয়দের বিরুদ্ধেও হয়। পক্ষদয় ধনী-গরীব যাই হোকনা কেন তাদের সকলে অপেক্ষা আল্লাহ উত্তম। তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরন করতে গিয়ে ন্যয় বিচার হতে বিরত থেক না”।
রাসূল (সাঃ) বলেন- “কোন ব্যক্তির এ অপরাধই যতেষ্ট যে, সে মালিক অথচ (শ্রমিকের) খোরাকী আটকিয়ে রাখে। (মুসলিম)
# অমুসলিম শ্রমিকের অধিকার: অমুসলিম শ্রমিকরাও মুসলিমদের ন্যয় অধিকার লাভ করে। যেমন আল্লাহ বলেন- “তোমরা সেই লেকদের গালি দিওনা মন্দ বলোনা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদের ডাকে”।(আনআম-১০৮)।
রাসূল (সাঃ) বলেন- সতর্ক থাক সে ব্যক্তি সম্পর্কে যে অমুসলিমদের উপর জুলুম করে বা হক নষ্ট করে অথবা শক্তির অধিক কাজ চাপিয়ে দেয় অথবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক কিছু নেয়। আমি কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব। (আবু দাউদ)।
# উপযুক্ত প্রশিক্ষনের অধিকার: শ্রমিকদের তিন ধরনের শিক্ষা লাভ করা তাদের অধিকার- ১। সাধারন শিক্ষা, ২। নৈতিক শিক্ষা, ৩। পেশাগত শিক্ষা। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন- “যাদের জ্ঞান নেই আর যাদের জ্ঞান আছে তার কখোনো সমান হতে পারে না। (সুরা যুমার ৯)। রাসূল (সাঃ) বলেন- প্রত্যেক মুসলমানের উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। (বুখারী)। এছাড়াও হাদিসে এসেছে- নিশ্চয় আল্লাহ চৌকস ও দক্ষ শিল্পী (শ্রমিক/কারিগড়) দের ভালবাসেন।

 

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, অধিকার বঞ্চিত শ্রমিক কঠোর পরিশ্রম করে মালিকদের বসবাসের জন্য রাজকীয় বালাখানা প্রস্তুত করছে অথচ সেই শ্রমিকেরই মাথা গুজাবার সামান্য ঘর টুকুও নেই। শ্রমিক মালিকের জন্য লক্ষ লক্ষ গজ কাপড় দিয়ে নানা কারুকার্য খচিত করে পোশাক রাজকীয় পোশাক তৈরী করছে অথচ তার গায়ে ছেড়া কাপড়। মালিক ককুরের খাবারের জন্য বাজেট করে অথচ শ্রমিকরা থাকে না খেয়ে। শ্রমিকের দ্বারা উপার্জিত অর্থ দিয়ে এসি গাড়ীতে ককুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অথচ শ্রমিক তার সামান্য মুজুরটুকুও পায় না। এভাবে বর্তমান পূঁজিবাদসহ পৃথিবীর সভ্যতার মতবাদ সমূহ শ্রমিকের মর্যাদা দেয়ার নামে অধিকার নষ্ট করে নির্যাতনকেই নিত্যকার কাজে পরিনত করেছে। অথচ পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আঃ) থেকে নিয়ে সকল নবী –রাসূলগন এমনকি অসংখ্য মুসলিম নিজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করাকে অত্যন্ত সম্মানের কাজ মনে করতেন। সবচেয়ে বড় অধিকারের ঘোষনা নিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেন- “শ্রমিকরা আল্লাহর বন্ধু”। এছাড়াও বলেছেন- যে ব্যক্তি কাজ করে নিয়ে শ্রমিককে পূর্ন মজুরী দেয়না মহান আল্লাহ নিজেই তার বিরুদ্ধে মামলা করবেন। তাই বলা যায়, ইসলামই কেবল নিশ্চিত করেছে শ্রমিকের পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা।

 

লেখক: আইনজীবি ও সাংবাদিক

rahimsnews@gmail.com

Check Also

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা!

অনলাইন ডেস্ক: নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন জেসিন্ডা আরডার্ন। ঘোষণাটি নিয়ে যে বিস্তর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *